নিজস্ব প্রতিবেদক : খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার অভাবে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এই ট্রান্স ফ্যাট মানুষের হৃদরোগ ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এমতাবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে কার্যকরের জন্য দাবি জানিয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সেমিনার কক্ষে ‘খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট, হ্নদ রোগের ঝুঁকি এবং করনীয়: ভোক্তা পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক বিভাগীয় সেমিনার ও আলোচনা সভায় এ দাবি জানানো হয়।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, ‘সরকার জনগণের কল্যাণেই আইন প্রণয়ন করে। এরপর সে আইনকে যুগোপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করে। আর এদিক থেকে অন্যদের চেয়ে অনেক বড় ভুমিকা রাখার কারণেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশবাসীর মনজয় করে নিয়েছেন।’
ডিসি বলেন, সম্প্রতি দেশের বিশিষ্ট গবেষকদের মাধ্যমে জানা গেছে মানব দেহের স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে ‘ট্রান্স ফ্যাট’। আর দীর্ঘ গবেষণার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ফলাফলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইন্সটিটিউট ঢাকা’র গবেষকগণ তাদের গবেষণায় এক অসাধারণ তথ্য প্রকাশ করেছেন। যে তথ্য জেনে দেশবাসী রীতিমত হতবাক হয়েছে। বর্তমান বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত করোনার ভয়াল মহামারীকালে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উদ্্ঘাটন করে আমাদের দেশের গবেষকগণ মানব কল্যাণের জন্য বিশাল অবদান রাখলেন। এখন জনগণের কল্যাণে সার্বক্ষনিক কাজ করা আওয়ামী লীগ সরকার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে (মানব খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ) অবশ্যই নীতিমালা প্রণয়ন করা নিয়ে ভাববেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে নীতিমালা প্রণয়ন কিছুটা হলেও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে এ মূহুর্তে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রথমে নিজকেই সচেতন হতে হবে। এর পাশাপাশি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ক্যাবের মত এমন উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী সফল করার জন্য সচেতন ভোক্তাদের সমন্বয়ে সেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর পূর্বের ন্যয় বর্তমান মহামারী পরিস্থিতিতে মানব কল্যাণে অবদান রাখা এ দেশের তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এমন মহৎ কাজে রাজশাহী জেলা প্রশাসন তরুণ সমাজের পাশে থাকবে।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী শাখার সভাপতি কাজী গিয়াস-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন- বিএসটিআই’র রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক মোঃ খায়রুল ইসলাম, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপ-পরিচালক অপূর্ব অধিকারী ও রাজশাহী সিভিল সার্জন প্রতিনিধি ডাঃ মোঃ খুরশিদুল ইসলাম।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক মোঃ গোলাম মোস্তফা মামুনের সার্বিক পরিচালনায় আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন ক্যাবের প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর খন্দকার তৌফিক আলহোসাইনী এবং প্রজ্ঞা’র ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর।
এরপর রাজশাহীর সহকারী জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শরিফুল হকের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন দৈনিক সোনালী সংবাদ’র সম্পাদক লিয়াকত আলী, মুক্তিযুদ্ধ রাজশাহী মহানগর কমিটির সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আব্দুল মান্নান, সিনিয়র সাংবাদিক ও সার্ক লিংক পিপলস্্ ফোরাম’র সভাপতি এ্যাড. মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মোঃ জামাত খান, মহানগর রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ আহমেদ, প্রকৌশলী খালেদ চৌধুরী পাইম, ক্যাব রাজশাহী শাখার যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদুল আলম মাসুদ, এ্যাড. শামসুন্নাহার মুক্তি প্রমুখ।
আলোচনা সভার সহায়তায় ছিলেন গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকি-উবেটর (জিএইচএআই) এবং সার্বিক সহযোগিতা করেন সম্মিলিতভাবে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলা-দেশ এবং গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)।
সেমিনারে জানানো হয়, খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস হচ্ছে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও), যা ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত। ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো জমে যায়, এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়। এই শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগ জনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (উবসবহঃরধ) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (ঈড়মহরঃরাব রসঢ়ধরৎসবহঃ) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫,৭৭৬ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ি এই ট্রান্স ফ্যাট।
ডব্লিউএইচও প্রকাশিত ‘ডঐঙ জঊচঙজঞ ঙঘ এখঙইঅখ ঞজঅঘঝ ঋঅঞ ঊখওগওঘঅঞওঙঘ ২০২০” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বিশ্বে ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে ১৫টি দেশে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অতিসম্প্রতি, ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রো-জেনেটেড অয়েল) ব্র্যান্ডসমূহের নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর গবেষকগণ। গবেষণায় ঢাকার পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। যা ডব্লিউএইচও-এর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতি-মালা না থাকায় মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। এমতাবস্থায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চসীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ পূর্বক কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন ক্যাব।
পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে মোড়কজাত খাবারের পুষ্টিতথ্য তালিকায় ট্রান্স ফ্যাটের সীমা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, উপকরণ তালি-কায় পিএইচও-এর মাত্রা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, ফ্রন্ট অব প্যাকেজ লেবেলস বাধ্যতামূলক করা যা খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি নির্দেশ করবে, এবং ‘ট্রান্স ফ্যাট-মুক্ত’ বা ‘স্বল্পমাত্রার ট্রান্সফ্যাট’ জাতীয় স্বাস্থ্যবার্তা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর এ ধরণের পদক্ষেপের ফলে খাদ্যপণ্যের উপাদান সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে বলেও কর্মশালায় জানানো হয়েছে।