রাবি প্রতিনিধি: দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২.০৯ শতাংশের যোগান দেয় ইলিশ। ২০১৯-২০ সালে দেশের মোট ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫.৩৩ লাখ টন। একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশ দেশের সর্ব্বোচ উৎপাদনশীল মাছ। ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে ও প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশের সুরক্ষার স্বার্থে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। ইলিশের প্রজনন সারা বছর ঘটে। তবে অক্টোবরের পূর্ণিমায় ৭০ শতাংশ ইলিশের প্রজনন হয়।
এসময় মা ইলিশ ডিম ছাড়তে সাগর থেকে নদীতে আসে। তবে গত কয়েক বছরের নিষিদ্ধ সময়কাল শেষ হওয়ার পরও নদীতে পাওয়া গেছে মা ইলিশ। ফলে প্রজননের জন্য যে নিষিদ্ধ সময়টা নির্ধারণ করা হচ্ছে তার সর্ব্বোচ সফলতা আসছে না।
তাই ‘ইলিশের সঠিক প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ’ এবং সে অনুযায়ী ইলিশ ধরার ‘নিষিদ্ধ সময়কাল পুনর্বিন্যাসে’ কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. ইয়ামিন হোসেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিউটের অধীনে ইলিশের মজুদ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে কাজ করছেন তিনি।
অধ্যাপক ইয়ামিন বলেন, সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ মাছের সর্ব্বোচ প্রজনন মৌসুম। ইলিশ মাছের প্রজনন লুনার সাইকেলের উপর অনুসরণ করে হয়। মৎস্য অধিদপ্তর পূর্ণিমার দিনকে অনুসরণ করে ২২ দিনের নিষিদ্ধ সময়কাল নির্ধারণ করে। এই বছর ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তবে এ বছর পদ্মা ও যমুনাতে মাছ আসতে শুরু করে ২০ অক্টোবর থেকে। অর্থাৎ নিষিদ্ধ সময় শুরু হওয়ার ৬-৭ দিন পর। একইভাবে মেঘনাতে ইলিশ মাছ প্রবেশ করে ৪-৫ দিন পর। আর বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় নদীতে দুই-একদিন পর প্রবেশ শুরু করে।
আবার একইভাবে নিষিদ্ধ সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেরিতে আসার কারণে পদ্মায় ৬-৭ দিন, মেঘনায় ৪-৫ দিন অতিরিক্ত সময় মাছগুলো থেকে যাচ্ছে। এই সময়ে কোন বিধি-নিষেধ না থাকায় জেলেরা মা ইলিশ ঠিকই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ সময়কাল নির্ধারণে কিছু অসংগতি থাকায় এ রকম ঘটনা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘটে আসছে। এ কারণে আমরা ইলিশ ধরা বন্ধ রাখার পূর্ণ সুফল পাচ্ছি না। তাই মা ইলিশ সংরক্ষণের ২২ দিনের যে সময়কাল আছে সেটার সঠিকতা যাচাই করাই আমাদের গবেষণার লক্ষ্য। নিষিদ্ধ সময় ২২ দিন থাকবে ঠিকই। কিন্তু পদ্মা যমুনার ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ আগে পরে হবে। মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারা ক্ষেত্রে ৪-৫ দিন। এটাই আমাদের গবেষণার তথ্য, উপাত্ত বলছে। এটা নিয়ে আরও গবেষণা হবে। ইলিশ উৎপাদনে আসছে দিনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারে এই গবেষণা।
গবেষণার অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, গত ৪ বছর যাবত ইলিশের সঠিক প্রজনন মৌসুম নির্ধারণে তথ্য সংগ্রহ করছি। আশা করছি আগামী বছরের জুনে গবেষণা কার্যক্রম শেষ করতে পারব এবং এ ইলিশ ধরা বন্ধ রাখার সময়কালটুকু যথাযথভাবে পুনর্বিন্যাস করতে পারবো। এছাড়াও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধকরণ এবং দেশের বাওরগুলোতে পুরনো দেশী মাছ ফিরিয়ে আনাসহ চারটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করছেন তিনি।
বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক সম্পদ সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্যে সমুদ্রে মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়কালটির কার্যকারিতা যাচাই এবং সমুদ্রে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত না করে কী পরিমাণ ধরা যায় তা নির্ধারণের লক্ষ্যে গবেষণা চলছে। এতে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, এই প্রজনন মৌসুমে ইলিশ যে পরিমাণ ডিম দিয়েছে তা যদি সংরক্ষণ না করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে ইলিশ মাছের হাহাকার পড়বে। তাই তিনি ঝাটকা মাছকে কঠোরভাবে সংরক্ষণ করার আহ্বান জানান।
২০১৫ সাল থেকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রজনন মৌসুমের সুরক্ষায় ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মাছ শিকার নিষিদ্ধ। গবেষণায় ভিন্ন চিত্র উঠে আসলে বদলে যেতে পারে এ সময়কালও।
সম্প্রতি স্কপাসের করা জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গবেষকদের মধ্যে প্রথম স্থানে উঠে এসেছেন এই অধ্যাপকের নাম। পৌঁছে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন পর্যন্ত সেরা ৫০ জন গবেষকের তালিকায়। ইতিমধ্যে গুণী এই গবেষকের ৮৬টি নিবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায়। নিবন্ধ প্রকাশে ছাড়িয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাককেও।